পায়ে ও গিঁটে ব্যথা হলে কি বাতজ্বর ?

blogspot 0 comments


পায়ে ব্যথা হলেই বাতজ্বর নয়
সালমার পায়ে ব্যথা। ১৫ বছরের এই মেয়েটির ২-৩ দিন যাবত সর্দি-কাশি-ঠান্ডার পর আজ থেকে শুরু হয়েছে পা ব্যথা। পায়ের থোরায় মাংশ ব্যথা করছে। ৫ বছর আগেও ওর এমনটি হয়েছিল। ডাক্তার অঝঙ করে বেশি পাওয়ায় ও প্রতিমাসেই মাংশে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নিচ্ছে। ওর মায়ের জিজ্ঞাসা ও এত ইঞ্জেকশন নিল, এখন ও নিচ্ছে। তাহলে ওর আবার বাতজ্বর হলো কেন?

সালমার মতো অনেক ছেলে-মেয়েরাই এরকম পায়ে-হাতে ব্যথার জন্য ডাক্তারের (!) শরণাপন্ন হলে তারা কিছু পরীক্ষার সাথে অঝঙ টাইটার করান। আর এই টাইটার বেশি পেলেই বাতজ্বর আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর পেনিসিলিন টেবলেট বা ইঞ্জেকশন দিতে থাকেন। পরে অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরনাপন্ন হলে অনেকেরই বাতজ্বর ভুল প্রমাণিত হয়। তবে কষ্টকর এই চিকিৎসার পিছনে ইতোমধ্যে অনেক অর্থ এবং সময় অযথা ব্যয় হয়ে যায়।
বাতজ্বর আসলে কি?
বাতজ্বরকে ইংরেজিতে বলে রিউমেটিক ফিভার। এটা বাচ্চাদের একটি প্রদাহজনিত রোগ। গলায় স্ট্রেপটোকক্কাস নামীয় অনুজীবের সংক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা আবার হৃৎপি-, ব্রেইন, পিঠে, চামড়া ইত্যাদি স্থানের টিস্যুকে আক্রমণ করে প্রদাহজনিত রোগের সৃষ্টি করে। এটা ৫-১৫ বছরের বাচ্চাদেরই বেশি হয়।
গলায় ঘা হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর, শিক্ষক, দলবদ্ধ হয়ে বাস করা পুলিশ, সৈনিকদেরই সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে স্ট্রেপটোকক্কাস দিয়ে গলাব্যথা জাতীয় রোগ হওয়ার ৭-৯ দিনের মধ্যে এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলেও বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
বাতজ্বর হলে বুঝবেন কি করে?
আগেই বললাম এই বাতজ্বর ব্রেইন, হৃৎপি-, গিঁটে, চামড়া ইত্যাদি অনেক স্থানকেই আক্রমণ করে। তাই কোন একক লক্ষণ বা পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তাররা এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করতে পারেন না। তাই অনেক গবেষণার পর একজন বিজ্ঞানী এটা নির্ণয়ের যে বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন তার নামানুসারে সেটা ‘জোনস ক্রাইটেরিয়া’ এবং কিছু পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে ‘পরিবর্তিত জোনস ক্রাইটেবিয়া’ নামে চিকিৎসকদের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় হয়ে আছে। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনি ৫টি মুখ্য এবং কিছু গৌণ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। সেই সাথে থাকতে হবে স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ। মুখ্য বৈশিষ্ট্যের যে কোন ২টি অথবা ১টি মুখ্যর সাথে ২টি গৌণ বৈশিষ্ট্য এবং সম্প্রতি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেলেই তাকে বাতজ্বর হিসেবে ধরতে হবে অন্যথায় নয়। এই মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑ (১) হৃৎপিন্ডের প্রদাহ (২) গিঁটে একদিক প্রদাহ (৩) ব্রেইন প্রদাহজনিত কাঁপুনি-খিঁচুনি (৪) চামড়ার লাল দাগ (৫) চামড়ার নিচে গিটুলি। আর গৌণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকতে পারেÑ গিঁটে হালকা ব্যথা, জ্বর ঊঝজ ও ঈজচ বেড়ে যাওয়া এবং ঊঈএ-তে চজ দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া। তবে এদের সাথে অবশ্যই সম্প্রতি সংক্রমণের প্রমাণ হিসেবে গলা পরীক্ষায় জীবাণুর অস্তিত্ব, বাড়তি অঝঙ টাইটার থাকতে হবে।
মুখ্য আর গৌণ বৈশিষ্ট্যের কিছু ধারণা
(১) হৃৎপ্রদাহ : শতকরা ৪০-৮০% বাচ্চার এটা হতে পারে। হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়া। হৃৎপিন্ড বড় হয়ে যাওয়া, অনিয়মিত স্পন্দন। বাড়তি হৃৎকম্পন দেখেও ডাক্তাররা এটা নির্ণয় করতে পারেন।
(২) গিঁটে প্রদাহ : শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর পায়ের হাতের বড় বড় গিঁটে এই প্রদাহ থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে এটা অবশ্যই গিঁটে ব্যথা। পায়ের থোড়ার মাংস ব্যথার সাথে বাতজ্বরের কোন সম্পর্কই নেই। আর এই ব্যথায় গিঁট যতটা না ফুলে যায় তার চেয়ে বেশি এবং অনেক বেশি ব্যথা অনুভূত হয়। অপর এসপিরিন জাতীয় ওষুধে খুব দ্রুত তা কমেও যায়। ব্যথা সাধারণত হাঁটু, গোড়ালি, কনুই এবং কবজিতে হতে পারে। এক জোড়ার ব্যথা কয়েকদিনের মধ্যে কমে গিয়ে বা চলে গিয়ে অন্যটায় তা দেখা দেয় অর্থাৎ জোড়া থেকে জোড়ায় স্থান পরিবর্তন করে। চিকিৎসা না করালেও ২ সপ্তাহের বেশি থাকে না। আর জোড়ায় দীর্ঘমেয়াদী কোন ক্ষতিও করতে পারে না। যা অন্য কোন কোন গিঁটে ব্যথা হয়ে থাকে। হাত-পায়ের ছোট ছোট জোড়ায়, চোয়ালের জোড়ায় এবং পিঠে কদাচিৎই এই প্রদাহ হয়। তাই এই বিশেষ এক জোড়া সেরে গিয়ে অন্যটা আক্রান্তের ধরন দেখে বাতজ্বরের গিঁটে ব্যথাকে চিনতে পারা যায়।
(৩) ব্রেইন প্রদাহজনিত কাঁপুনি-খিঁচুনি : শতকরা মাত্র ১০-১৫ ভাগ মানুষের বাতজ্বরে এই উপসর্গ দেখা দেয়। হাতের লেখা খারাপ হয়ে যাওয়া স্কুলের ফলাফল খারাপ হওয়া মুখ ভেংচির মতো করা ইত্যাদি বিভিন্ন উপসর্গ দিয়েও এটা প্রকাশ পায়। ঘুমালে লক্ষণগুলো চলে গেলেও বিশ্রামের সময় কিন্তু থেকে যায়। হার্ট-ভালবের রোগ নিয়ে থাকা বাতজ্বরের আক্রান্ত রোগীদের কয়েক দশক পরেও এই উপসর্গ আসতে দেখা গেছে। এইসব রোগীদের জোনস ক্রাইটেরিয়া না মিললেও বাতজ্বর বলে ধরে নেয়া হয়।
(৪) চামরায় লাল দাগ : ১ থেকে ৩ সেন্টিমিটার পরিধির চারদিকের দাগগুলো সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসেই আবার মিশেও যায়। এবং এতে কোন চুলকানি থাকে না। শতকরা মাত্র ১ ভাগ রোগীর এটা হতে পারে।
(৫) চামড়ার নিচের গিঁটুলি : এই গিঁটুলিও মাত্র ১% রোগীর হয়। হাঁটু কনুই, পিঠ ইত্যাদি স্থানে ব্যথামুক্ত এই গিঁটুলিগুলো দেখা যায়।
গৌণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে জ্বর ও গিঁটে হালকা ব্যথাই প্রধান। গিঁটে প্রদাহ অর্থাৎ ফুলাসহ বেশি ব্যথা এবং হৃৎপ্রদাহের সময় ১০২ ডিগ্রি ফা.হা. পর্যন্ত জ্বর হয়। তবে চিকিৎসা ছাড়াও এই জ্বর ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে চলে যায়।
বাতজ্বরের মারাত্মক ক্ষতি কি কি?
এই বাতজ্বর থেকে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতিটা হয় তা হলো হার্টের মাইট্রাল ভালব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে কোন কোন রোগীর এওটিক ও ট্রাইকাসপিড ভালবও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভালবগুলো ঠিকমতো কাজ করে না বা রাস্তা সরু করে হৃৎপিন্ডের রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে। আবার প্রথমবারই গুরুতর হৃৎপেশির প্রদাহ হলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তবে পূর্ব থেকেই হৃদরোগ থাকলে বা বারবার আক্রান্ত হলে এই রোগীদের ফলাফল খারাপ হয়।
কি পরীক্ষা করাবেন?
রোগ নির্ণয়ের জন্য পরিবর্তিত জোনস ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করাটাই নিয়ম। তবে গৌণ বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব দেখার জন্য ঊঝজ, ঈজচ দেখা হয়। আর সম্প্রতি সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে গলার রস কালচার, অঝঙ, অহঃর উহধংব ই ইত্যাদি করা হয়। শতকরা ৮০ ভাগ রোগীরই অঝঙ বেশি পাওয়া যায়। আর হৃৎরোগ দেখার জন্য ঊঈএ এবং ঊঈঐঙ করা হয়।
চিকিৎসা হয় কিভাবে?
জ্বর ব্যথা কমানো এবং ভবিষ্যতে হৃদরোগ থেকে রোগীকে রক্ষার জন্য এন্টিবায়োটিক সেবনই আসল চিকিৎসা। আক্রান্তের ধরন অনুযায়ী রোগীকে ২ থেকে ৬ সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে হবে। গিটে ব্যথা জ্বরের জন্য এসপিরিন এবং হৃৎপ্রদাহ সাথে থাকলে স্টেরয়েড দিয়ে ৬-৮ সপ্তাহ চিকিৎসা দেয়া হয়। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার ৮-৯ দিনের মধ্যে পেনিসিলিন মুখে বা মাংসে নিতে হবে। এরপর রোগীর ধরন অনুযায়ী পরবর্তী আক্রান্ত প্রতিরোধে ৫ বছর থেকে আজীবন এই পেনিসিলিন ব্যবহার করতে হয়। ব্রেইনের কাঁপুনি-খিঁচুনি হলে খিঁচুনি প্রতিরোধে ওষুধ ব্যবহার করা হয়। মারাত্মক আক্রান্ত হৃৎভালবের জন্য কখনও কখনও শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
প্রতিরোধ করতে হলে যা জানতেই হবে
Ñগলা ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
Ñস্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণ মনে হলে পেনিসিলিন শুরু করতে হবে।
Ñবাতজ্বরের ক্রাইটেরিয়া মিলে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চালাতে হবে। স্কুল/মাদ্রাসা/কলেজ ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সৈনিকদের কেউ বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে তাদের সহপাঠী/সহকর্মীরা অবশ্যই গলাব্যথা, ঢোক গিলতে সমস্যার মতো উপসর্গ হলেই দ্রুত চিকিৎসকের সাহায্যে নিবেন।
ডা. জহুরুল হক সাগর
নবজাতক, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ
healthjournalbd
Google+ Pinterest

0 Response to " পায়ে ও গিঁটে ব্যথা হলে কি বাতজ্বর ? "

  • Commented politely and wisely in accordance with the content.
  • Comments are not needed by other readers [spam] will be removed immediately.
  • If the article entitled " পায়ে ও গিঁটে ব্যথা হলে কি বাতজ্বর ? " is useful, share to social networks.
Code Conversion